আমাদের দেশ লাখো শহীদের রক্তের দামে কেনা। এই দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য সম্ভ্রম হারিয়েছেন অগণিত মা-বোন। ১৯৫২ থেকে শুরু কওে ’৭১ এর সেই রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্যদিয়েই আজকের ‘সোনার বাংলা’; বাংলাদেশ। এদেশের প্রতি আমাদের সবার যে মমত্ববোধ, তা কোনো কিছুর বিনিময়ে বিলীন হওয়ার নয়। তবে আমাদের বর্তমান প্রজন্ম তাদের অতীত ইতিহাস-ঐতিহ্য ও এদেশের সমৃদ্ধ সংস্কৃতিচর্চা থেকে ছিটকে পড়ছে, যা মোটেই কাম্য নয়। আমাদের দেশাত্মবোধক গান, জারি-সারি-ভাটিয়ালী, বাউল-সুফি, আমাদের অঞ্চলভিত্তিক জন্মগত ভাষাপ্রীতি ও মাছ-ভাত, লুঙ্গি-শাড়ির সোনালী শিল্প-সংস্কৃতিকে বাদ দিয়ে বিদেশী কৃষ্টি-কালচারের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে। স্যাটেলাইট প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় ইন্টারনেট আজ হাতের মুঠোয়। এদেশের উঠতি প্রজন্মকে কিছুতেই প্রচলিত সমাজ-সংস্কৃতিতে মাতিয়ে রাখা যাচ্ছে না। তারা ভিন্নধর্মী সংস্কৃতির প্রতিই বেশি আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে। অবিশ্বাস্য হলে সত্য, তাদের বাংলা কথা বলাটাও এখন ইংরেজির মতো শুনায়!
আমাদের বর্তমান প্রজন্ম ধীরে ধীরে অপসংস্কৃতিতে ডুবে যাচ্ছে। যে বয়সে শিশুর হাতে খেলনা পুতুল থাকার কথা, অত্যাধুনিকতার নামে ওই বয়সেই তার হাতে দেয়া হচ্ছে স্ক্রিনটাচ্ মোবাইল ডিভাইস, যা দিয়ে সে দৈবাকৃতির প্রাণীদের দিক নির্দেশনা দিচ্ছে। ফলে মানুষের প্রতি যে স্বাভাবিক আচরণ, সহানুভূতি কিংবা শ্রদ্ধাবোধ -এসব থেকে সে অনেক দূরে সরে যাচ্ছে। অন্যদিকে টিভি-সিরিয়াল ও বিদেশী ভাষার এনিমেটেড কার্টুনগুলোর প্রতি চরম আসক্তির কারণে প্রায় বাড়ির টিভি’র রিমোট ডিভাইস্টি থাকে তাদের হাতে। ফলে প্রয়োজনে দৈনন্দিন খবর-বার্তা, বিজ্ঞানভিত্তিক অনুষ্ঠান তথা সুষ্ঠু ধারার বিনোদন থেকে এই প্রজন্ম কিছুই শিখছে না। বরং তাদের কাছে অকালপক্কতাই জীবনের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমতাবস্থায়, আমাদের অভিভাবকমহলকে গুরুদায়িত্ব নিতে হবে। প্রথম কাজ হবে- সন্তানদের প্রতি লালনপালনের যে দায়িত্ব তা পালনে ব্যর্থ হওয়ার জন্য অনুতাপ’সহ দু:খপ্রকাশ, দ্বিতীয়ত: বিপথগামী সন্তানদেরকে সুপথে ফিরিয়ে আনার নিরন্তর প্রচেষ্টা।
প্রকৃতপক্ষে, দেশপ্রেম এমন একটি মহৎগুণ, যার মধ্যে দেশপ্রেম আছে তার কাছে দেশের সাথে সম্পর্কিত সবকিছুর মূল্য অতুলনীয়। সে নিজের জীবন বাজি রেখে দেশের স্বার্থরক্ষা ও সমৃদ্ধির পথে অটল থাকে। তাই আমাদেরকে প্রথমেই দেশপ্রেমের দীক্ষা নিতে হবে। নিখাঁদ স্বদেশপ্রেম আমাদেরকে দিতে পারে পৃথিবীতে টিকে থাকার অব্যর্থ মন্ত্রের সন্ধান। আর এভাবেই আমরা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম নিজের দেশকে বিশ্বের বুকে সফলতার সাথে তুলে ধরার দায় নিতে পারবো। পক্ষান্তরে, দেশদ্রোহী মনোভাব আমাদেরকে বর্বর জাতি পরিণত করবে। কিছু অলৌকিক ও পার্থিব মোহে বিবেক বিলিয়ে দিয়ে দেশের চরম ক্ষতি করতেও তার হাত কাঁপবে না। দেশের সম্পদ হলো মাতৃদুগ্ধ সম। অথচ এসব পথহারা পথিক নিজের ব্যক্তিগত সুবিধা হাসিল করতে পারলে তার মায়ের সম্মান জ্বলাঞ্জলী দিতেও কার্পণ্য করে না। তার কাছে দেশপ্রেম বলতে কিছুই নেই, উচ্চ-বিলাস বহুল জীবন ও রিপুর চাহিদা পূরণ হলেই তার বুদ্ধিমত্তাকে বিসর্জন দিতে সে প্রস্তুত। প্রয়োজনে ‘জ্ঞানপাপী’র ভূমিকায় অভিনয় করতেও রাজি হয়ে যায় নির্দি¦ধায়।
দেশাত্ববোধ জাগ্রত করা প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক দায়িত্ব। তাই পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রতি সচেতন দৃষ্টি ও জীবন চলার পথে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে কখনো ভুল করা যাবে না। শত বাধা-বিপত্তিকে মাড়িয়ে ‘নিজস্বতাবোধ’কে আঁকড়ে ধরতে হবে। আর মায়ের মতো করে ভালোবাসতে হবে দেশকে, দেশের মানুষকে। তবেই আমরা বীরের জাতি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠাকে ধরে রাখতে পারবো, অন্যথায় বহি:শত্রু তাদের ষড়যন্ত্রের জালে আমাদেরকে নিমিষেই ঘায়েল করে ফেলবে। তাই এই অশুভ শক্তিগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে। আর নিজেদের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। জয় বাংলা।
লেখক: কবি ও সাংবাদিক
পাঠকের মতামত: